Details Published on Sunday 04 June 2023 06:30 Written by Radical Socialist
নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন যেভাবে করা হল, তা চারটি কারণে অসম্মানজনক, এবং তা দেখায়, বিজেপি সরকার কতটা ধারাবাহিকভাবে নামে ছাড়া সব দিক থেকেই একটি হিন্দুরাষ্ট্র কায়েমের দিকে এগিয়ে চলেছে। প্রথমত, রাষ্ট্রপতিকে উদ্বোধন করতে তো বলাই হয় নি,, এমনকি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকার আমন্ত্রণ পর্যন্ত করা হয় নি। এ হল ভারতের উদারনৈতিক গণতন্ত্র যে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠাপর্বের নীতি এবং পদ্ধতির উপরে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে সচেতনভাবে লঙ্ঘন করা ও তার ভিত্তি দুর্বল করার পদক্ষেপ। রাষ্ট্রপতি মুর্মু যে এই ব্যবহারে সম্মতি জানিয়েছেন, তা দেখিয়ে দেয়, তিনি মোদীর হুকুমের কতটা বশংবদ। দ্বিতীয়ত, এই অন্যায্য ক্ষমতা দখলের পাশে দেখা এল, কেবলমাত্র মোদী অংশগ্রহণকারীদের প্রতি ভাষণ দিলেন, তিনি একাই পাদপ্রদীপে থাকলেন। এটা একদমই তার মাত্রধিক অহমিকার সঙ্গে মিলে যায়। তিনি কেবল একতরফা ভাষণ দিতে ভালবাসেন, এবং নিজের ছবি সব জায়গায় দেখাতে ভালবাসেন, আর সে এমন মাত্রায় যা গোয়েবলস হিটলারের জন্য যা করেছিল তাকেও হার মানায়। এক্ষেত্রে অবশ্যই তলানীটা দেখা গিয়েছিল নাগরিকদের দেওয়া প্রত্যেকটা কোভিড সার্টিফিকেটে মোদির ছবি সেঁটে।
উদ্বোধনে সেঙ্ঘর আনা এবং সেটা স্থায়ীভাবে নতুন পার্লামেন্ট ভবনে স্পীকারের আসনের পাশে রাখাকে ইতিহাসের নামে গাজাখুরি গল্পের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা ছাড়া ভারতীয় গণতন্ত্রের তাৎপর্যকে হীনভাবে দেখানোর দুটো প্রয়াস হিসেবে দেখা যায়। রাজতন্ত্রী এবং হিন্দু প্রতীকের প্রতি সম্মান দেওয়া মোদী সরকারের ভারতীয় রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদের সাধারণতন্ত্রী এবং রাজতন্ত্র-বিরোধী চরিত্রের প্রতি অবজ্ঞার প্রতীকও। এখন ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে হিন্দু জাতীয়তাবাদ হিসেবে দেখানোর জন্য এই প্রতীক। এটা খুবই ইতিবাচক, যে প্রায় গোটা বিরোধীপক্ষ এই ঘটনাটা বয়কট করেছে। যেটা আশ্চর্যের,তা হল কয়েকটা অ-বিজেপি দল বয়কট করে নি, এবং কিছু উদারনৈতিক বলে পরিচিত ব্যক্তি মন্তব্য করেছেন যে এ নাকি যৌথ গণতান্ত্রিক উতসব যেটা বয়কট করা উচিত হয় নি। বাস্তবে এ ছিল হিন্দুত্ব প্রকল্পকে এগিয়ে নেওয়ার সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ, এবং একে গ্রহণ করার অর্থ মোদী সরকারের মেকী দাবিকে মেনে নেওয়া যে তাঁরা ভারতীয় গণতন্ত্রের ও ভারতের পুরোন জাতীয়তাবাদের প্রকৃত রক্ষাকর্তা।
***** ***** *****
ব্রিজভূষণ সিংকে পকসোতে ধরা তো দূরের কথা, তার বিরুদ্ধে ঠিকমতো অনুসন্ধান করা হয় নি, এটাই যথেষ্ট খারাপ ছিল। কিন্তু তার উপর সংসদ উদ্বোধনে তার হাজিরা দেখিয়ে দিয়েছে, বিজেপি সরকারের কাছে মেয়েদের বিরুদ্ধে তার অত্যাচারের অপরাধ গৌণ, তার রাজনৈতিক ক্ষমতা অনেক বড়। তাই তারা মহিলা কুস্তিগিরদের জন্য ন্যায় বিচারের কোনো চেষ্টা করবে না। বরং, কেন্দ্রীয় হুকুমের সেবাদাস হয়র, দিল্লী পুলিশ ঠিক করল যে কুস্তিগিরদের নতুন সংসদ ভবনের দিকে মিছিল করার প্রস্তাব তাঁদের ও তাঁদের সমর্থকদের উপর শারীরিক হামলা করার ও তারপর গণহারে গ্রেপ্তার করার যথেষ্ট অজুহাত। জন্তর মন্তরে তাঁদের অস্থায়ী আস্তানা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে, এবং পরে তাঁরা ছাড়া পেলেও, আর ওখানে ফিরতে দেওয়া হচ্ছে না। যারা অন্য ব্যাপারে বিজেপির এবং মোদির সমর্থক, তাদের অনেকের মধ্যেও কুস্তিগিরদের প্রতি যথেষ্ট সমর্থন আছে। এই সব মোদীভক্তদের একাংশ কী নতুন করে ভাববে? প্রধানমন্ত্রী জগতের সবকিছু নিয়ে কথা বলে যেতে ভালবাসেন, বিশেষ করে ভারতীয় নারীত্বের জন্য তার শ্রদ্ধা ও চিন্তার কথা বলতে ভালবাসেন। কিন্তু এই বিজেপি সাংসদের করা যৌন হয়রানির বিবরণ সম্পর্কে তিনি মুখে কুলুপ এঁটে থেকেছেন। এটা মোদীর স্বভাবসিদ্ধ মৌনতার অঙ্গ, যখনই আর এস এস-এর বিভিন্ন কর্মী, বাঁ নেতার করা হাজার হাজার প্রকাশ্য অপরাধের এবং নৃশংসতার সমালোচনা করার কথা ওঠে। এই সরকার যেন মনে করছে যে তারা অপেক্ষা করবে, কতদিনে কুস্তিগিরদের দম ফুরোয়। তাদের আশা, দিল্লীর কেন্দ্রে জনসমক্ষে আন্দোলন বন্ধ হওয়ায় এঁদের লড়াই এবং সেটার প্রতি মানুষের সমর্থন দুটোই কমে যাবে। এটা হতে দেওয়া চলবে না। সমস্ত প্রগতিশীল শক্তিকে সমর্থন দিয়ে যেতে হবে, যতদিন না ন্যায়বিচার হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যেন জাতীয়তাবাদি বয়ানে এবং অযথা গৌরবদানে জড়িয়ে না পড়ি। বড় বেশী মানুষ এবং গণমাধ্যমে মন্তব্যকারী বারে বারে বলেছেন, কুস্তিতিররা কত আন্তর্জাতিক পদক জিতেছেন, দেশের জন্য ‘সম্মান’ এনেছেন। এতে যেন তাদের লড়াইটা জোরালো হচ্ছে। ব্রিজমোহন সিংয়ের আচরণ সবচেয়ে কড়া ভাষায় নিন্দা করতে হবে, তাকে সবচেয়ে কড়া সাজা দিতে হবে, সে কুস্তিগিররা তাঁদের খেলার জগতে যতটা বা যতটুকু সফল হোন না কেন। এই যে সাহসী লড়াই চলছে, তা থেকে যে প্রাথমিক সাধারণ নীতি বেরচ্ছে, সেটা হল, মেয়েদের, এবং সব মানুষের যারা যৌন নির্যাতনের শিকার হন, তাঁদের মর্যাদা ও অধিকারের প্রতি সম্মান জানানো। এই নীতিকে সবরকমভাবে সমর্থন করতে হবে।
আন্দোলনকারী মহিলারা বলেছেন, তাঁরা গঙ্গাতে তাঁদের পদক বিসর্জন দেবেন, এবং তারপর আমরণ অনশনে বসবেন। আমরা তাঁদের এই পদক্ষেপ না নিতে আবেদন করছি। কাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি সেই অনুযায়ী আন্দোলনের রূপ স্থির করুতে হয়। যে সরকারের উত্থান ধর্ষণের সংস্কৃতিকে মদত দিয়ে, তারা কৃতি মেয়েদের, বা যে কোনো সংখ্যক মেয়ের মৃত্যুতে সামান্যতম লজ্জা পাবে না। নারী আন্দোলনের কর্মীদের, এবং সবরকম বিজেপি বিরোধী সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে আমরা আহ্বান করছি, এই লড়াইয়ের প্রতি সংহতি জানিয়ে আরো বেশি সংখ্যায় জমায়েত হতে। আমরা মানুষকে মনে করিয়ে দিচ্ছি, ১৬ ডিসেম্বর ২০১২র পর কিভাবে দেশজোড়া গণ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, এবং সকলকে আহ্বান করছি, আরো জীবন নাশের আগে সক্রিয় হতে ।
৩০ মার্চ, ২০২৩