Home Socialist and Peoples' History জুলাইয়ের দিনগুলি --দানিয়েল গাইডো

জুলাইয়ের দিনগুলি –দানিয়েল গাইডো

Details
Published on Saturday
25 November 2017 19:01
Written by Radical Socialist

 

জুলাইয়ের দিনগুলি

দানিয়েল গাইডো

বলশেভিকরা পারী কমুনের ভাগ্য এড়াতে চেয়েছিলেন। তাই তাঁরা ১৯১৭-র জুলাইতে ক্ষমতা নেন নি।

১৮ই জুন , ১৯১৭ : পেত্রোগ্রাদে রাজনৈতিক শোভাযাত্রা। বাঁ দিকের ব্যানারে লেখা আছেঃ “সারা দুনিয়ার জন্য শান্তি – জনগণের হাতে সব ক্ষমতা – জনগণের হাতে সব জমি”। ডানদিকের ব্যানারে আছেঃ “পুঁজিবাদী মন্ত্রীরা নিপাত যাক”। এগুলি ছিল বলশেভিক স্লোগান। 

১৯১৭ সালে রাশিয়াতে ছিলেন ১৬.৫ কোটির বেশী নাগরিক, যাদের মধ্যে মাত্র ২৭ লাখ থাকতেন পেত্রোগ্রাদে। রাজধানীতে থাকতেন ৩৯০,০০০ জন ফ্যাক্টরী শ্রমিক – এক তৃতীয়াংশ নারী –২১৫,০০০ থেকে ৩,০০,০০০ জন সৈনিক যারা ছাউনীতে থাকতেন, আর মোটামুটি ৩০,০০০ নাবিক ও সৈনিক যারা থাকতেন নিকটবর্তী ক্রোনস্টাড নৌ ঘাঁটিতে।

ফেব্রুয়ারী বিপ্লব এবং জার দ্বিতীয় নিকোলাসের পদত্যাগের পর, মেনশেভিক এবং সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীদের নেতৃত্ত্বাধীন সোভিয়েতরা ক্ষমতা হাতে তুলে দিল এক অ-নির্বাচিত অস্থায়ী সরকারের হাতে, যারা বদ্ধপরিকর ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার অংশগ্রহণ  চালিয়ে যেতে, সংবিধান সভার নির্বাচন পর্যন্ত কৃষি সংস্কারের বিলম্ব ঘটাতে, আর সংবিধান সভার নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতুবী রাখতে।

ঐ সোভিয়েতগুলিই সৈনিকদের কমিটি গড়ার ডাক দিয়েছিল, এবং তাঁদের বলেছিল শ্রমিক ও সৈনিকদের প্রতিনিধিদের সোভিয়েতের নির্দেশ ও ডিক্রীর পরিপন্থী যে কোনো সরকারী নির্দেশ অমান্য করতে।  

এই স্ববিরোধী সিদ্ধান্তগুলি তৈরী করল একটি নড়বড়ে দ্বৈতক্ষমতা, যাতে দেখা দিল বারে বারে সরকারের সংকট। এই রকমের প্রথম সংকট দেখা দিল এপ্রিল মাসে, যার কারণ ছিল যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, এবং যা শেষ হল যখন দুই প্রধান বুর্জোয়া রাজনৈতিক নেতা – সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক দল বা ক্যাডেট দলের পাভেল মিলিউকভ এবং অক্টোব্রিস্ট দলের আলেক্সান্দর গুচকভ বহিস্কৃত হলে তবে। উপরন্তু, এই সংকট দেখিয়ে দিল, পেত্রোগ্রাদ ছাউনীর উপর সরকারের অক্ষমতা। সৈন্যরা তৎকালীন সেনা প্রধান জেনারাল লাভর কর্নিলভের নয়, বরং পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের কার্যনির্বাহী কমিটির ডাকে সাড়া দিল।

পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের ১নং নির্দেশ, যা প্রকাশিত হয় পাশ্চাত্য ক্যালেন্ডারের ১৪ই মার্চ।

এই দলিলে সমস্ত সামরিক ইউনিটদের আহবান করা হয়, সৈনিকদের কমিটি নির্বাচন করার, সোভিয়েতে প্রতিনিধি পাঠাবার, এবং অফিসারদের ও অস্থায়ী সরকারকে মানার কেবল যদি তাঁদের নির্দেশ পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের নির্দেশ ও ডিক্রির পরিপন্থী না হয়।  সমস্ত অস্ত্র এই কমিটিদের হাতে তুলে দিতে বলা হয়, “এবং কোনো অবস্থাতেই যেন, এমনকি দাবী করলেও যেন, অফিসারদের দেওয়া না হয়”।

এই সংকট থেকে যে জোট সরকার বেরিয়ে এল, তাতে ছিলেন বুর্জোয়া ফলগুলি থেকে ন’জন মন্ত্রী আর তথাকথিত সমাজতন্ত্রী দলগুলি থেকে ছ’জন। প্রিন্স ল’ভভ প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্র দপ্তরের মন্ত্রী থেকে গেলেন, কিন্তু যুদ্ধমন্ত্রী ও নৌবহরের মন্ত্রী হলেন সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারী দলের আলেক্সান্দার কেরেনস্কী, এবং তিনি দ্রুত পরিণত হলেন সরকারের উঠতি তারকা।ক্যাবিনেটে আরো রইলেন মেনশেভিক দলের ইরাকলি সেরেতেলি – ডাক ও তাঁর বিভাগের মন্ত্রী হিসেবে, এবং মাতভেই স্কোবেলেভ – শ্রম দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে। কৃষি মন্ত্রী এবং বিচার বিভাগের মন্ত্রী হিসেবে জোটে যোগদান করলেন সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারী ভিক্টর চের্নভ এবং পাভেল পেরেভেরঝেভ।

১৯১৭র গ্রীষ্মকালে বলশেভিক দল

১৯১৭র প্রথমার্ধে বলশেভিকদের কষ্ট করে লড়তে হয়েছিল। তাঁরা প্রথমে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মিছিলের বিরোধিতা করেছিলেন, যে মিছিল থেকে ফেব্রুয়ারী বিপ্লব ঘটে। তারপর মার্চের মাঝামাঝি থেকে বলশেভিক দল ভালরকম ডাইনে মোড় নেয়, যখন লেভ কামেনেভ, যোসেফ স্তালিন এবং এম কে মুরানভ সাইবেরিয়া থেকে ফিরে পার্টির মুখপত্র প্রাভদার উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন। তাঁদের নিয়ন্ত্রণে পত্রিকাটি অস্থায়ী সরকারের প্রতি সমালোচনামূলক সমর্থন প্রস্তাব করে, “যুদ্ধ নিপাত যাক” স্লোগানের বিরোধিতা করে, এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর মধ্যে ভাঙ্গন আনার কাজ বন্ধ করতে আহবান করে।

লেনিনের ‘দূর থেকে চিঠি’ গুলিতে ব্যক্ত মতের সঙ্গে এই মত তীব্র বৈপরীত্য দেখায়। সুতরাং এটা খুব বিস্ময়কর না, যে প্রাভদা সেগুলির কেবল প্রথমটাকে প্রকাশ করেছিল, এবং তাও আবার অনেক ছেঁটেকেটে । আলেক্সান্দার শ্লিয়াপনিকভের সাক্ষ্য অনুযায়ীঃ

“সংস্কারপ্রাপ্ত প্রাভদা”র প্রথম সংখ্যা প্রকাশনার দিন, অর্থাৎ ১৫ই মার্চ, ছিল “দেশরক্ষাবাদীদের” বিজয়োল্লাসের যুগ। গোটা টাউরিডে প্রাসাদ জুড়ে একটাই খবর উপচে পড়ছিল, ডুমা কমিটির সদস্যদের থেকে বিপ্লবী গণতন্ত্রের হৃদয়স্থল [সোভিয়েতের] কার্যনির্বাহী কমিটি পর্যন্ত – অতিবামদের উপর  নরমপন্থী, যুক্তিবাদী বলশেভিকদের জয়ের খবর। খোদ কার্যনির্বাহী কমিটিতে আমাদের দেখানো হয় বিষাক্ত হাসি।

যখন ৩রা এপ্রিল লেনিন ফিনল্যান্ড স্টেশনে উপস্থিত হন, তখন এই মতামতই বলশেভিক নেতাদের মধ্যে প্রধান ছিল। পরদিন, তিনি সারা রাশিয়া শ্রমিক ও সৈনিক সোভিয়েতদের সম্মেলনের জন্য আগত বলশেভিক প্রতিনিধির সামনে তাঁর এপ্রিল থিসিস (“April Theses”) পেশ করেন। কামেনেভ ও স্তালিনের বিপরীতে, লেনিন “বিপ্লবী প্রতিরক্ষাবাদকে” সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করলেন, এবং যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বমূলক আচরণের প্রস্তাব রাখেন। উপরন্তু তিনি লিওন ট্রটস্কীর দিশা গ্রহণ করে বলেন “বিদ্যমান মূহুর্ত” হল বিপ্লবের প্রথম “বুর্জোয়া-উদারনৈতিক” পর্ব থেকে দ্বিতীয় “সমাজতন্ত্রী” পর্বে উত্তরণের সময়, যখন ক্ষমতা চলে যাবে শ্রমিক শ্রেণীর হাতে।

লেনিন বিরোধিতা করলেন স্তালিন ও কামেনেভের অস্থায়ী সরকারের প্রতি “সীমাবদ্ধ সমর্থনের” নীতির, তার বদলে ঐ সরকারকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করার ডাক দিলেন, এবং বলশেভিকরা কম জঙ্গী মেনশেভিকদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হবেন এই ধারণাকে কাটিয়ে দিলেন। তখন থেকে, বলশেভিকরা সোভিয়েতদের হাতে সব ক্ষমতা হস্তান্তরের ডাক দিতে থাকেন, যে সোভিয়েতরা জনগণকে সশস্ত্র করবে, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের বিলুপ্তিসাধন করবে,  সমস্ত জমিদারী বাজেয়াপ্ত করবে, এবং উৎপাদন ও বন্টনের নিয়ন্ত্রণ শ্রমিকদের হাতে হস্তান্তর করবে।

বলশেভিক দলের সপ্তম (এপ্রিল) সারা রাশিয়া সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় পেত্রোগ্রাদে, ২৪ থেকে ২৯ এপ্রিলে। এই সম্মেলনে যুদ্ধ এবং অস্থায়ী সরকার প্রসঙ্গে লেনিনের অবস্থান সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন লাভ করে।

লেনিনের “এপ্রিল থিসিস”-এর প্রথম পৃষ্ঠা, প্রাভদায় প্রকাশিত

 

১৯১৭-র গোড়ায় বলশেভিক পার্টি ছিল ছোটো, পেত্রোগ্রাদে তাঁদের সদস্য ছিলেন মোটামুটি দু’হাজার, যা হল শহরের শিল্প শ্রমিকদের মাত্র ০.৫ শতাংশ। এপ্রিল সম্মেলনের মধ্যে পার্টির সদস্য সংখ্যা কেবল রাজধানীতেই বেড়ে হয়েছিল ষোল হাজার। জুনের শেষদিকে তা আবার দ্বিগুণ হয়। সেনা ছাউনীর দু’হাজার সৈন্য বলশেভিক সামরিক সংগঠনে যোগ দিয়েছিলেন, এবং আরো চার হাজার জন ক্লাব প্রাভদা নামে বলশেভিক সামরিক সংগঠন পরিচালিত সৈনিকদের জন্য একটি অপার্টি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। সদস্য সংখ্যার এই বিশাল বৃদ্ধি সংগঠনের রূপান্তর ঘটালো। তাতে এলেন দলে দলে নতুন সদস্য, যারা আবেগ প্রবণ, মার্ক্সসীয় তত্ত্ব কম জানেন কিন্তু বিপ্লবী লড়াইয়ের জন্য আকুল।  

ইতিমধ্যে বলশেভিকরা অন্যান্য সংগঠনদের নিজেদের দলে টেনে নিতে শুরু করলেন। ৪ঠা মে, জোট সরকার গঠনের আগের দিন, নির্বাসন থেকে ফিরলেন ট্রটস্কী। তিনি এবং লেনিন এখন একি জমিতে দাঁড়িয়ে দেখে ট্রটস্কী তাঁর সংগঠন, মেঝরায়ন্তসি বা পেত্রোগ্রাদের আন্ত:-জেলা সংগঠনকে লেনিনের দলের সঙ্গে যুক্ত করতে আরম্ভ করলেন।   

এই দ্রুত বিকাশ সত্ত্বেও বলশেভিকরা তখনও সংখ্যালঘু ছিলেন। ৩ রা জুন, শ্রমিক ও সৈনিকদের প্রতিনিধিদের সোভিয়েতদের প্রথম সারা রাশিয়া কংগ্রেস যখন শুরু হল, তখন তাঁরা ছিলেন মোট প্রতিনিধিদের দশ শতাংশেরও কম। জাতীয় স্তরের এই সভাতে ছিলেন ১০৯০ জন প্রতিনিধি, যাদের মধ্যে ৮২২ জনের ভোট দেওয়ার অধিকার ছিল। ছিলেন তিন শতাধিক শ্রমিক, সৈনিক ও কৃষক সোভিয়েতের এবং ৫৩টি আঞ্চলিক, প্রাদেশিক ও জেলা সোভিয়েতের প্রতিনিধি। ১০৫ জন প্রতিনিধি নিয়ে বলশেভিকরা ছিল তৃতীয় বৃহত্তম শক্তি, সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীদের (২৮৫) এবং মেনশেভিকদের ( ২৪৮ জন প্রতিনিধি) পিছনে।

এই সময়ে পেত্রোগ্রাদে বলশেভিক পার্টির তিনটি স্বতন্ত্র পার্টি নেতৃত্ব ছিল – নয় সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি, সারা রাশিয়া সামরিক কমিটি, এবং পিটার্সবুর্গ কমিটি। প্রত্যেকের নিজস্ব দায়িত্ব ছিল, যার ফলে তাঁরা স্বতন্ত্র, এবং কখনও কখনও পরস্পর-বিরোধী চাপের মুখে পড়তেন। কেন্দ্রীয় কমিটিকে গোটা দেশের কথা মাথায় রাখতে হত। ফলে তাঁরা অনেক সময়ে বেশী জঙ্গী গোষ্ঠীদের রাশ টেনে ধরতে বাধ্য হতেন।

জুলাইয়ের প্রেক্ষাপট

বলশেভিক সামরিক সংগঠন স্থির করে, তারা ১০ই জুন অস্থায়ী সরকা্রের প্রস্তাবিত সামরিক আক্রমণের বিরুদ্ধে, সেনা ছাউনীতে শৃংখলার নামে কেরেনস্কী যেভাবে অফিসারদের কর্তৃত্ব ফেরাতে চাইছে তার বিরুদ্ধে, এবং রণক্ষেত্রে সেনা পাঠানোর হুমকীর বিরুদ্ধে গণ অসন্তোষ জানানোর জন্য প্রকাশ করতে একটি সশস্ত্র মিছিল ডাকবে। শেষ মূহুর্তে সোভিয়েত কংগ্রেসের বিরোধিতার কাছে নতি স্বীকার করে তারা মিছিল রদ করে।

বলশেভিক পার্টির কিছু কিছু সদস্য, বিশেষ করে পিটার্সবুর্গ কমিটিতে এবং সামরিক সংগঠনে, মনে করেছিলেন যে প্রস্তাবিত মিছিলটি হবে সম্ভাব্য সামরিক অভ্যুত্থান। বস্তুত, একটি জরুরী সভাতে লেনিনকে হাজির হতে হয়েছিল, প্রস্তাবিত মিছিলটি রদ করার পক্ষে কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তের পক্ষে বলার জন্য। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে কেন্দ্রীয় কমিটি বাধ্য হয়েছিল, সোভিয়েত কংগ্রেসের আনুষ্ঠানিক নির্দেশ মানতে, এবং বলেন যে প্রতিবিপ্লবীরা ঐ মিছিলকে নিজেদের কাজে লাগাবার চক্রান্ত করেছিল।

 

 বলশেভিক সামরিক সংগঠন

 

লেনিন যোগ করেনঃ

সাধারণ যুদ্ধেও এরকম ঘটে, যে রণনীতিগত কারণে পরিকল্পিত আক্রমণ রদ করতে হয়েছে , এবং আমাদের শ্রেণীযুদ্ধে সেটা ঘটার সম্ভাবনা আরো বেশী … পরিস্থিতি বুঝে সাহসের সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

সোভিয়েত কংগ্রেস স্থির করল, এক সপ্তাহ পরে, ১৮ই জুনে, তার নিজের মিছিল হবে। সেনা ছাউনীর সবকটি ইউনিটকে নির্দেশ দেওয়া হল, তারা যেন নিরস্ত্রভাবে মিছিলে আসে। বলশেভিকরা চার লাখের বেশীর এই মিছিলকে অস্থায়ী সরকার বিরোধী এক বিশাল বিক্ষোভে রূপান্তরিত করলেন। নিকোলাই সুখানভের প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে আমরা পড়িঃ (https://archive.org/stream/russianrevolutio011007mbp/russianrevolutio011007mbp_djvu.txt

পিটার্সবুর্গের সমগ্র শ্রমিক ও সৈনিক সমাজ এতে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু এই মিছিলের রাজনৈতিক চরিত্র কী ছিল? “আবার বলশেভিক”, আমি মন্তব্য করি, স্লোগানগুলো দেখে, “আর তাঁর পিছনে আরো একটি বলশেভিক মিছিল” … “সভিয়েতের হাতে সব ক্ষমতা!” “দশজন পুজিপতি মন্ত্রী নিপাত যাক!’, “কুঁড়ে ঘরের জন্য শান্তি, প্রাসাদের উপরে যুদ্ধ!” এই শক্তিশালী ভাষায় শ্রমিক – কৃষকের পিটার্সবুর্গ, রুশ ও বিশ্ব বিপ্লবের অগ্রণী শক্তি, নিজের মত জানাল।

১০ইয়ের মিছিলে বলশেভিকদের অন্যতম মিত্র ছিল পেত্রোগ্রাদ ফেডারেশন অফ অ্যানার্কো-কমিউনিস্টস। অ্যানার্কিস্ট প্রভিশনাল রেভল্যুশনারী কমিটি তাঁদের মিত্রদের থেকে আরো একধাপ এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাইবর্গ জেল ভেঙ্গে বন্দী বলশেভিক সামরিক সংগঠনের পত্রিকা সম্পাদক খাউস্তভকে বার করে আনে।

এর জবাবে সরকার নৈরাষ্ট্রবাদীদের সদর দপ্তর হানা দেয়, এবং আস্নিন নামে তাঁদের একজন নেতাকে হত্যা করে। একদিকে কেরেনস্কীর জুলাই সামরিক আক্রমণ, আরেকদিকে নতুন অস্ত্র ও ফৌজে নতুন লোক আনার নির্দেশ, এবং তার সঙ্গে আস্নিনের হত্যা, সেনাবাহিনীর মধ্যে, বিশেষ করে প্রথম মেশিন গান রেজিমেন্টে, চাঞ্চল্য বাড়িয়ে তুলল। এই সৈনিকেরা অ্যানার্কো-কমিউনিস্টদের মদতে ১লা জুলাই থেকে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করতে থাকেন।

বলশেভিক সামরিক সংগঠনদের সারা রাশিয়া সম্মেলনে প্রতিনিধিদের সাবধান করা হল, তাঁরা যেন সরকারের ফাঁদে না পড়েন, অসময়ে, অসংগঠিত অভ্যুত্থান না ঘটান। ২০ জুন লেনিনের বক্তৃতায় আগাম এই কথাটাই বলা হয়ঃ

আমাদের বিশেষভাবে নজর রাখতে হবে, সাবধান থাকতে হবে, যাতে আমরা ফাঁদে পা না দিই … । আমরা একটা ভুল পদক্ষেপ নিলে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে … । আমরা যদি এখন ক্ষমতা দখল করতেও পারি, আমরা তা ধরে রাখতে পারব মনে করা হবে ছেলেমানুষী।

আমরা একাধিকবার বলেছি যে বিপ্লবী সরকারের একমাত্র সম্ভাব্য রূপ হল শ্রমিক, সৈনিক ও কৃষকদের প্রতিনিধি পরিষদ।

সোভিয়েতে আমাদের ফ্র্যাকশনের নির্দিষ্ট ভর কী? এমন কি দুই রাজধানীর সোভিয়েতেও আমরা নিতান্ত সংখ্যালঘু, অন্যান্য জায়গার কথা তো বলাই বাহুল্য। এই তথ্য কী দেখায়? এটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এটা দেখায় যে জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ দোদুল্যমান, কিন্তু এখনও এস আর এবং মেনশেভিকদের উপর আস্থা রাখছেন।

প্রাভদায় একটি সম্পাদকীয়তে লেনিন এই ধারণাতে ফিরে এলেন।

সেনাবাহিনী কুচকাওয়াজ করে মরতে গেল, কারণ তারা বিশ্বাস করেছিল, তারা স্বাধীনতা, বিপ্লব এবং দ্রুত শান্তির জন্য ত্যাগ স্বীকার করছে।

কিন্তু সেনাবাহিনী সেই কাজ করেছে কারণ তারা জনগণেরই একটি অংশ, যারা বিপ্লবের বর্তমান স্তরে সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারী এবং মেনশেভিক দলদের অনুসরণ করছে। এই সাধারণ ও মৌলিক সত্য, যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেনশেভিক এবং সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীদের পেটি বুর্জোয়া নীতিতে আস্থা রাখছেন, যে নীতি ধনিকদের উপর নির্ভরশীল, আমাদের পার্টির অবস্থান ও আচরণকে নির্ধারণ করছে।

কিন্তু, ট্রটস্কীর কথায় (https://www.marxists.org/archive/trotsky/1930/hrr/ch24.htm ) শ্রমিক ও সৈনিকদেরঃ

মনে ছিল যে ফেব্রুয়ারীতে তাঁদের নেতারা বিজয়ের পূর্বাহ্নে পিছু হঠতে প্রস্তুত ছিলেন; যে মার্চে আট ঘন্টার শ্রম দিবস আদায় হয়েছিল নিচের তলা থেকে লড়াই করে; যে এপ্রিলে মিলিউকভকে রেজিমেন্টরা নিজস্ব উদ্যোগে রাস্তায় নেমে ছুঁড়ে ফেলেছিল। এই তথ্যগুলি স্মরণে আসায় জনতার উত্তেজিত এবং অস্থির মানসিকতা তীব্রতর হয়েছিল।

পেত্রোগ্রাদের সামরিক সংগঠনের নিচের দিকের নেতারা অস্থায়ী সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি পদক্ষেপ নেওয়ার মতের মোটামুটি সমর্থক ছিলেন, এবং বহু সাধারণ বলশেভিক দ্রুত অভ্যুত্থানকে অনিবার্য এবং কাম্য বলেই মনে করছিলেন।

কিন্তু ঠিক যখন কেরেনস্কীর আক্রমণ ধ্বসে পড়ার মুখে, তখনই সরকার আবার এক সংকটে পড়ল। ইউক্রেনের কেন্দ্রীয় রাডার সঙ্গে কেরেনস্কির রফার প্রতিবাদে চারজন ক্যাডেট মন্ত্রী জোট সরকার ছেড়ে গেলেন। এই আচমকা পদক্ষেপের ফলে সরকারে এখন থাকল ছ’জন সমাজতন্ত্রী ও কেবল পাঁচজন বুর্জোয়া মন্ত্রী, এবং সরকার অসংগঠিত ও বিপন্ন হয়ে পড়ল। জুলাইয়ের দিনগুলি যখন শুরু হয়, ঠিক তখনই পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের শ্রমিক শাখাতে বলশেভিকরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেন, যা প্রমাণ করল, জনগণের মধ্যে তাঁদের প্রভাব বাড়ছিল।

সশস্ত্রমিছিল

জুলাইয়ের দিন নামে পরিচিত ঘটনাবলীর সূচনা হয় ৩রা জুলাই, যখন প্রথম মেশিন গান রেজিমেন্ট, অন্য কিছু সামরিক ইউনিটের সমর্থনে বিদ্রোহ শুরু করে। এই বিদ্রোহ শুরু হয় বলশেভিকদের দ্বিতীয় পেত্রোগ্রাদ নগর সম্মেলন চলছে এমন সময়ে (এই সম্মেলন শুরু হয় ১ জুলাই)।

যখন স্পষ্ট বোঝা গেল যে বেশ কয়েকটি রেজিমেন্ট পথে নেমেছে, তাঁদের সমর্থন করছে ব্যাপক শ্রমিক, এবং সাধারণ বলশেভিকরাও অংশ নিয়েছেন, তখনই  কেন্দ্রীয় কমিটি লড়াইয়ের অংশীদার হল, এবং পরামর্শ দিল যে পরদিন মিছিল সংগঠিত হোক বলশেভিকদের পতাকায়। যদিও কেন্দ্রীয় কমিটি বুঝেছিল যে প্রতিবাদীরা অস্ত্র নিয়ে বেরোবেন, কেন্দ্রীয় কমিটির পরামর্শে সশস্ত্র অভ্যুত্থান বা সরকারী প্রতিষ্ঠানদের দখলের কোনো কথা বলা হল না। বরং পার্টির প্রস্তাবে শ্রমিক, সৈনিক ও কৃষকদের সোভিয়েতের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বলশেভিক আহবানেরই পুনরাবৃত্তি করা হল। এইভাবে বলশেভিক সামরিক সংগঠন একটি আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করল, যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে। এই অপ্রত্যাশিত বিস্ফোরণ পার্টিকে বিশৃংখলায় ঠেলে দিল। যারা কেন্দ্রীয় কমিটির কথা মেনে বিপ্লবকে পিছিয়ে দেওয়ার কথা বললেন, দেখা গেল তাঁদের সঙ্গে অন্যদের দ্বন্দ্ব হচ্ছে, বিশেষ করে সামরিক সংগঠনের এবং পিটার্সবুর্গ কমিটির সদস্যদের।

একটি বিপ্লবী দলের অবশ্যই বিপ্লবের সময়ে অসাধারণ বৃদ্ধি হয়। আমরা দেখেছি, পেত্রোগ্রাদে পাঁচ মাসের কম সময়ে বলশেভিক পার্টি বেড়েছিল ১৬০০ শতাংশ।  এই ঘটনা পার্টিকে অভূতপূর্ব চাপের মুখে ফেলেছিল। সেটা পার্টির বিভিন্ন সংগঠনে বিভিন্ন মাত্রায় দেখা দিয়েছিল, এবং সংগঠনকে ছিঁড়ে ফেলার বিপদ দেখা দিয়েছিল। কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা এটা ঠেকাতে পারে না। বিপ্লবী ঘটনাবলী কীভাবে এগোবে, তা নির্ভর করে অনেক রকম পরিস্থিতির উপর, যার মধ্যে একটি হল পার্টি নেতৃত্ব কতটা আস্থা অর্জন করতে পেরেছে। এই কারণেই দল গড়ার কাজটা বিপ্লবের আঁচ লাগার পরও শুরু করা যায় না, যেটা প্রমাণ করেছিল জার্মান বিপ্লব।

৩রা জুলাই সশস্ত্র বিক্ষোভকারীরা কেরেনস্কীকে গ্রেপ্তার করার ব্যর্থ চেষ্টার পর টাউরিডে প্রাসাদের দিকে এগিয়ে গেলেন। এই প্রাসাদে ছিল সোভিয়েত কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির আসন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, এই সংস্থাকে বাধ্য করা, যেন তারা অস্থায়ী সরকারের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়।

আনুমানিক ষাট থেকে সত্তর হাজারের এই জনতা প্রাসাদের প্রতিরক্ষা হঠিয়ে দিয়ে নিজেদের দাবী পেশ করেন। কার্যনির্বাহী কমিটি তা প্রত্যাখ্যান করল। ট্রটস্কী ঐ মূহুর্তের বিদ্রূপাত্মক চেহারাটা তুলে ধরে মন্তব্য করেছেন, যখন লাখ লাখ প্রতিবাদী চাইছিলেন যেন সোভিয়েত নেতারা ক্ষমতা হাতে তুলে নেন, তখন নেতারা এই বিক্ষোভ মিছিলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায় এমন সামরিক শক্তি খুঁজছিলেন।

ফেব্রুয়ারী বিপ্লবের পর শ্রমিক ও সৈনিকরা মেনশেভিক ও সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীদের ক্ষমতা দিয়েছিলেন, কিন্তু এই দলগুলি চেষ্টা করল সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে, নিজেদের হাতে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের চেয়ে জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে কাম্য মনে করে।  যখন জুলাইয়ের বিক্ষোভকারীরা বুঝলেন যে সোভিয়েতের  নেতারা তদের পুঁজিবাদী মিত্রদের ছাড়বেন না – যদিও তাঁদের অনেকে সরকার ছেড়ে দিয়েছিল – তখন পরিস্থিতি একটা বদ্ধ জায়গাতে আটকে পড়ল।

“কুত্তার বাচ্চা, যখন তোমাদের ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে সেটা নিয়ে নাও!

পরের দিন লেনিন ফিরে এলেন ফিনল্যান্ড থেকে, এবং তিনি সোজা চলে গেলেন ক্সেসিন্সকায়ার প্রাসাদে বলশেভিকদের সদর দপ্তরে। অল্প পরে, ক্রোনস্টাডের নৌঘাঁটি থেকে নাবিকরাও সেখানে উপস্থিত হলেন। অক্টোবর বিপ্লব পর্যন্ত লেনিনের এই ছিল শেষ প্রকাশ্য বক্তৃতা, এবং তিনি যা বললেন সেটা নাবিকদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না। তিনি শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর জোর দিলেন এবং নিশ্চয়তা প্রকাশ করলেন যে “সোভিয়েতদের হাতে সব ক্ষমতা” স্লোগান জয়যুক্ত হবেই। তিনি বক্তৃতা শেষ করলেন নাবিকদের আত্মসংযম দেখাতে, দৃঢ়তা দেখাতে, এবং সজাগ থাকতে আহবান করে।

জুলাইয়ের দিনগুলি বলশেভিক কেন্দ্রীয় কমিটিকে, এবং লেনিনকে, এক ভিন্ন আলোকে দেখালো। তাঁরা রাজধানীতে একটি অকালীন অভ্যুত্থানঠেকালেন। যদি সেটা ঘটে যেত, তাহলে বলশ্রেভিকরা নিঃসঙ্গ হতে পারতেন, এবং বিপ্লবকে গুঁড়িয়ে দেওয়া যেতে পারত, যেমন হয়েছিল পারী কমিউনে ১৮৭১ সালে এবং বার্লিনের স্পার্টাকাস অভ্যুত্থানে ১৯১৯ সালে।   

সেদিনও আনুমানিক ষাট হাজারের একটি মিছিল টাউরিডে প্রাসাদের দিকে রওনা হয়, কিন্তু তাঁদের দিকে গুলি চালানো হয় নেভস্কি এবং লিটেইনি স্ট্রীটের মোড়ে, এবং আবার লিটেইনি ও প্যান্টেলেমোনোভ স্ট্রীটের মোড়ে। তবে সবচেয়ে বেশী হতাহত হয় দুটি কসাক স্কোয়াড্রনের সঙ্গে সংঘর্ষে। তারা বিক্ষভকারীদের বিরুদ্ধে এমনকি গোলন্দাজদের ব্যবহার করে। রাস্তার উপরে এইমসরাসরি যুদ্ধের পর ক্রোনস্টাডের নাবিকরা ফিওদোর রাসকোলনিকভের নেতৃত্বে টাউরিডে প্রাসাদে পৌঁছে প্রথম মেশিন গান রেজিমেন্টের সঙ্গে যোগ দিলেন। 

তারপর ঘটে সেদিনের অন্যতম নাটকীয় ঘটনা, যা ছিল একাধারে ট্রাজিক ও হাস্যকর। সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীদের তাত্ত্বিক বলে পরিচিত নেতা ভিক্তর চের্নভকে পাঠানো হল প্রতিবাদীদের ঠান্ডা করতে। জনতা তাঁকে বন্দী করে, এবং একজন শ্রমিক ঘুষি পাকিয়ে তাঁকে বলে, “কুত্তার বাচ্চা, যখন তোমাদের ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে সেটা নিয়ে নাও!”

চের্নভকে গ্রেপ্তার করার ঘোষণা করে তাঁকে কাছে একটি গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। ট্রটস্কির হস্তক্ষেপে মন্ত্রী বেচে গেলেন। সুখানভ সেই দৃশ্যের বিবরণ দিয়েছেনঃ

যতদূর দেখা যাচ্ছিল, জনতা ছিল উত্তেজিত … গোটা ক্রোনস্টাড ট্রটস্কীকে চিনত, এবং মনে করা যায়, বিশ্বাস করত। কিন্তু তিনি বলতে শুরু করলেও জনতা ঠান্ডা হল না। যদি সেই মূহুর্তে উস্কানীমূলকভাবে কেউ একটা গুলি চালাত, তাহলে এক ভয়ানক হত্যাকান্ড ঘটে যেত, এবং আমাদের সকলকে, হয়তো ট্রটস্কীকেও, ছিড়ে ফেলা হত। ট্রটস্কী এত উত্তেজিত ছিলেন যে এই হিংস্র আবহাওয়াতে ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তিনি অতি কষ্টে একেবারে সামনের সারির লোকেদের তাঁর কথা শোনাতে পারছিলেন… । তিনি যখন চের্নভের কাছে যেতে চেষ্টা করেন, গাড়ির কাছের সৈন্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করে। ট্রটস্কী বলেনঃ “আপনারা এসেছেন আপনাদের মত জানাতে, এবং সোভিয়েতকে দেখাতে যে শ্রমিক শ্রেণী আর বুর্জোয়া শ্রেণীকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না । কিন্তু আপনারা কেন নগণ্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক কাজের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষতি করবেন? … আপনারা প্রত্যেকে বিপ্লবের প্রতি তাঁর আনুগত্য দেখিয়েছেন। আপনারা প্রত্যেকে বিপ্লবের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত। আমি সে কথা জানি। আপনার হাতটা দিন, কমরেড। ভাই, আপনার হাত দিন!” ট্রটস্কী হাত বাড়িয়ে দিলেন বিশেষভাবে হিংস্রতা দেখিয়ে প্রতিবাদ করছিল এমন এক নাবিকের দিকে। … আমার মনে হল যে ঐ নাবিক, যে নিশ্চয়ই ক্রোনস্টাডে ট্রটস্কীকে একাধিকবার শুনেছে, তার এখন মনে হচ্ছিল যে ট্রটস্কী বেইমান হয়ে গেছে; তাঁর মনে পড়ছিল পুরোনো বক্তৃতাগুলি, এবং তাঁর সব গুলিয়ে যাচ্ছিল…। কী করতে হবে বুঝতে না পেরে ক্রোনস্টাদের নাবিকরা চের্নভকে ছেড়ে দিল।

পেত্রোগ্রাদ, ৪ জুলাই ১৯১৭। সৈন্যরা গুলি চালানো শুরু করলে নেভস্কি প্রসপেক্টে বিক্ষোভকারীরা নিরাপদ জায়গা খুঁজছেন।

চের্নভ টাউরিডে প্রাসাদে ফিরে গেলেন এবং বলশেভিকদের নিন্দা করে আটটা সম্পাদকীয় লিখলেন। সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারীদের পত্রিকা দিয়েলো নারোদা শেষ অবধি তাঁর চারটি প্রকাশ করেছিল।

কিন্তু অস্থায়ী সরকার সার্বিকভাবে এর চেয়ে অনেক জঘন্যভাবে বদলা নিল — পরদিন, তারা এক মিথ্যা প্রচার শুরু করল, যে লেনিন (যিনি বন্ধ ট্রেনে করে জার্মানীর মধ্য দিয়ে রাশিয়াতে এসেছিলেন) জার্মান সেনাপতিদের চর।

প্রতিক্রিয়ার সাময়িক বিজয়

৫ই জুলাই সোভিয়েত কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি এবং পেত্রোগ্রাদ সামরিক জেলা কর্তৃপক্ষ শহর দখল নিতে সামরিক অভিযান শুরু করল। সরকারের অনুগত ফৌজ ক্সেসিন্সকায়ার প্রাসাদ দখল করে এবং প্রাভদার ছাপাখানা ভেঙ্গে দেয়। লেনিন কোনোক্রমে পালিয়ে যেতে পারেন। তিনি ধরা পড়লে তাঁর পরিণতি স্পার্টাকাস অভ্যুত্থানের পরে রোজা লুক্সেমবুর্গ ও কার্ল লিবকনেশটের মত হত কি না তা নিয়ে ভেবে হয়তো লাভ নেই। কিন্তু দুদিন পরে পেত্রগ্রাদস্কায়া গাজেতা নামে দক্ষিণপন্থী সংবাদপত্রে এই ছবিটা ছাপা হয়েছিল। এ থেকে একটা সূত্র বেরোতে পারেঃ

লেনিন একটা উঁচু পদ চায়?… বটে? তার জন্য একটা পদ তৈরী আছে

সরকারের অনুগত সৈন্যরা পিটার ও পল দূর্গ দখল করল, যেটা বলশেভিক সামরিক সংগঠনের কথা অনুযায়ী প্রথম মেশিন গান রেজিমেন্ট তাঁদের কাছে সমর্পন করল। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি পার্টির অনুগামীদের কাছে নির্দেশ পাঠাল, তাঁরা যেন পথে মিছিল করা বন্ধ করেন; শ্রমিকদের কাজে ফিরে যেতে এবং সৈনিকদের ছাউনীতে ফিরতে আহবান করা হল।

ইতিমধ্যে সরকার নির্দেশ দিল যে লেনিন, কামেনেভ ও গ্রিগরী জিনোভিয়েভ সহ নেতৃস্থানীয় বলশেভিকদের এবং ট্রটস্কী এবং আনাতোলি লুনাচারস্কি সহ আন্তঃ জেলা সংগঠনের নেতাদের যেন গ্রেপ্তার করা হয়। ট্রটস্কী সহ এই রাজবন্দীদের কয়েকজন, কর্নিলভের অভ্যুত্থানের সময়ে শ্রমিকদের প্রতিরোধ গড়তে জেল থেকে বেরোন, কিন্তু অন্যরা অক্টোবর বিপ্লব পর্যন্ত জেলেই থাকেন।

এইভাবে শেষ হল জুলাইয়ের দিনগুলি — লেনিনের ভাষায় “মিছিলের চেয়ে অনেকটা বেশী আর বিপ্লবের চেয়ে কম”। বলশেভিক পার্টির কিছু নেতাকে আত্মগোপন করতে হয়। পার্টির সংবাদপত্রগুলি বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু এই পিছু হঠা ছিল সাময়িক। দক্ষিণপশ্চিম ফ্রন্টে একাদশ আর্মির আক্রমণ ব্যর্থ হল, জার্মান এবং অস্ট্রিয় ফৌজ বিপুল প্রত্যাক্রমণ করল, আর সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকল। ফলে বলশেভিকদের স্লোগান যে ন্যায্য, তা আবার বোঝা গেল।

বলশেভিক পত্রিকারা শীঘ্রই সামান্য নাম পরিবর্তন করে প্রকাশিত হল। পার্টি কমিটিরা নতুন করে পায়ের তলায় জমি খুঁজে পেল। আর বিদ্রোহী সামরিক বাহিনীগুলির অস্ত্র কেড়ে নেওয়া, যেমন চেয়েছিল সরকার, তা হুকুম দেওয়া যত সহজ ছিল, বাস্তবে করা অত সহজ ছিল না। অগাস্ট ১৯১৭তে কর্ণিলভের ষড়যন্ত্র পরাস্ত হলে চাকা আবার ঘুরে গেল। বলশেভিকদের ক্ষমতা দখলের সফল প্রয়াসের পূর্বশর্ত তৈরী হল।

 

 

 অনুবাদঃ কুণাল চট্টোপাধ্যায়

RELATED ARTICLES

Bombay: The Stalinist Leadership and the Destruction of the Left

Details Published on Sunday 04 April 2010 17:19 Written by Radical Socialist

The Forgotten Massacres

Details Published on Thursday 04 June 2015 02:47 Written by Radical Socialist

The German Reunification and the Left

Details Published on Saturday 22 November 2014 17:57 Written by Radical Socialist

Most Popular

Golpe in Peru: Castillo under arrest, people demand a constituent assembly

Details Published on Sunday 01 January 2023 09:48 Written by Radical Socialist

When buying cheap turns out expensive

Details Published on Thursday 07 February 2013 04:23 Written by Radical Socialist When buying cheap turns out expensive Sunday 20 January 2013, by Esther Vivas Three, two, one, zero… The...

Russia: The Return of Fascism

Details Published on Saturday 08 January 2011 08:00 Written by Radical Socialist Boris Kagarlitsky There was nothing unexpected about the racially motivated rioting and attacks that took place in...

South America: end of a cycle? Popular movements, “progressive” governments and eco-socialist alternatives

Details Published on Friday 11 December 2015 05:10 Written by Radical Socialist Thursday 10 December 2015, by Franck Gaudichaud More than 40 years after the coup d’état that defeated...

Communalism – Its Causes And Consequences

Details Published on Thursday 13 October 2009 06:13 Written by Radical Socialist

Cancer in India’s nuclear workers

Details Published on Wednesday 29 February 2012 18:26 Written by Radical Socialist

Alexis, what have you done with our victory?

Details Published on Thursday 16 July 2015 14:24 Written by Radical Socialist Alexis, what have you done with our victory? Tuesday 14 July 2015, by Andreas Sartzekis OKDE-Spartakos   61.3 % vote...

Massive popular uprising in Greece

Details Published on Friday 24 June 2011 00:51 Written by Radical Socialist Massive popular uprising in Greece Hundreds of thousands of Greek “Outraged” walk out to wage war against...

The Arab Revolution has started

Details Published on Thursday 03 February 2011 11:06 Written by Radical Socialist The Arab Revolution has started Declaration of the DIP (Initiative for a Revolutionary Workers Party of Turkey)...

Asian left: `Lift the siege on Gaza! Support boycott, divestment and sanctions on apartheid Israel’

Details Published on Tuesday 29 June 2010 02:42 Written by Radical Socialist Statement by Asian left organisations June 25, 2010 -- As Israel stands increasingly isolated following its manufactured...